আজকের শিশু কন্যা আগামী দিনের একজন মহীয়সী নারী—আহসান হাবীব
বিশেষ প্রতিনিধিঃ
বর্তমান আধুনিক ও শিক্ষিত সমাজব্যবস্থায় আমরা কথায় কথায় বলি, ‘সন্তান ছেলে হোক আর মেয়ে হোক মানুষ হওয়াটাই আসল কথা।’ কিন্তু অনেকেই আভিধানিকভাবে তা মানলেও মনে মনে ঠিকই চিন্তা করেন ‘সন্তান হতে হবে ছেলে’। কন্যাসন্তান হওয়ার ক্ষেত্রে একজন নারীর কোনো ভূমিকা নেই, এই প্রমাণিত সত্যটি শিক্ষিত পুরুষটি জানার পরও মানসিকভাবে অনেক ক্ষেত্রেই এ দায় চাপিয়ে দেন নারীর উপর। ফলে কোনো অন্যায় না করে আমাদের দেশে হাজার হাজার নারী কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অভিযোগে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন ভোগ করে। শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী, মধ্যবিত্ত, গরিব নির্বিশেষে আমাদের সমাজে এমনকি নিজের পরিবারেও আমরা লক্ষ্য করে থাকি মেয়েশিশুর প্রতি অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈষম্যমূলক আচরণ। ফলে অনেকাংশেই দরিদ্রতার প্রথম শিকার হয় কন্যাশিশুরা। কিছু সামাজিক কথিত নীতির কারণে শিশুকাল থেকেই কন্যাশিশুদের এমনভাবে গড়ে তোলা হয় যাতে করে তারা প্রতিবাদী হতে না শেখে। তাদের প্রতি করা বৈষম্যমূলক আচরণকে অন্যায় হিসেবে না দেখে বরং সহজাত ও সমঝোতার সঙ্গে গ্রহণ করতে শেখানো হয়। যা পরবর্তী সময়ে নারীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার পথটিকে প্রশস্ত করতে সাহায্য করে। বাল্যবিবাহ নারীর প্রতি বৈষম্য ও নারী নির্যাতনের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে দেশের ৬৮ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার এবং বাল্য বিবাহের শিকার মেয়েদের মধ্যে মাত্র ৭ শতাংশ মেয়ে বিবাহ পরবর্তী সময়ে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে। অবশিষ্টাংশ লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে দিয়ে স্বামী সেবায় নিয়োজিত হন, ফলে শিশুটি মায়ে পরিণত হন। বছর ঘুরতেই এই অপরিণত মা একটি রুগ্ন, স্বাস্থ্যহীন ও পুষ্টিহীন শিশুর জন্ম দেন। ইউনিসেফের প্রতিবেদনে দেখা গেছে আমাদের দেশে, ৬৬ ভাগ কিশোরীর বাল্যবিবাহের শিকার। এদিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় সর্বোচ্চ। ফলে প্রতি তিন জনের মধ্যে একজন কিশোরী অল্প বয়সেই মা হচ্ছেন। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণায় কন্যাশিশুদের বিয়ের সংখ্যা আনুপাতিক হারে কমলেও গ্রাম এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখনো এই হার অনেক বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশের অর্ধেক অর্থাত ৪৯.৯৪ শতাংশ নারী। তাই দেশের ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়নের জন্য পুরুষের পাশাপাশি নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি জরিপের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১০-১২ বছর বয়সী কিশোরদের তুলনায় কিশোরীরা শকতরা ৮ ভাগ কম ক্যালরি পায়, ১৩-১৫ বছর বয়সী কিশোরী শতকরা ১৮ ভাগ কম ক্যালরি পায়। পুষ্টির এ বঞ্চনা অধিকাংশ কিশোরীর স্বল্প উচ্চতা ও স্বল্প ওজনের কারণ। মানবজাতিকে টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি নারী করে থাকেন, তবু তাদের জীবন প্রক্রিয়াই যদি সংকটাপন্ন হয় এরচেয়ে অমানবিক আর কী হতে পারে! সরকারের যুগোপযোগী শিক্ষানীতির কারণে প্রাথমিক শিক্ষায় কন্যাশিশুর অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেলেও নারী শিক্ষার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, পারিবারিক কাজের দায়ভার, নিরাপত্তাহীনতা, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি কারণে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হয়।

আইসিডিডিআরবি এবং প্ল্যান বাংলাদেশের যৌথ জরিপ মতে, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করা ২৬ শতাংশ নারীর বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে। নিরক্ষর নারীদের বেলায় এই সংখ্যা ৮৬ শতাংশ। সরকার বিগত বছরগুলোতে ছাত্রী ও নারীদের শিক্ষায় অংশগ্রহণ উত্সাহিত করার জন্য নারীবান্ধব কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। যার ফলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলসমূহে ছাত্রী অনুপ্রবেশ এবং লিঙ্গ সমতা নিশ্চিতকরণে অনেকটাই উন্নতি করেছে। শিক্ষা নারীর ক্ষমতায়নের চাবিকাঠি। শিক্ষা কন্যাশিশুর উন্নয়ন, বাল্যবিবাহ রোধ এবং শিশু মৃত্যুর হার কমানোর নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। শিশু অধিকার রক্ষাকল্পে ১৯৫৪ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক এক প্রস্তাবে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর একদিন ‘শিশু দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফলে প্রতিবছর ২৯ সেপ্টেম্বর ‘শিশু অধিকার দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। কন্যা শিশুর প্রতি লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য রোধে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুষ্ঠু বিকাশের বিষয়টিকে বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে ২০০০ সালে তত্কালীন সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি সরকারি আদেশের মাধ্যমে শিশু অধিকার সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনকে কন্যাশিশু দিবস হিসেবে পালনের লক্ষ্যে ৩০ সেপ্টেম্বরকে ‘জাতীয় কন্যা শিশু দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। তখন থেকেই প্রতিবছর যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালিত হচ্ছে। কন্যাশিশু ও নারীকে অবজ্ঞা, বঞ্চনা ও বৈষম্যের মধ্যে রেখে কখনোই একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ে উঠতে পারে না। এই বাস্তবতায়, নারী ও কন্যাশিশুর শিক্ষার বিকাশ অত্যন্ত জরুরি। সেটি শুরু করতে হবে কন্যাশিশুর জন্য সর্বোচ্চ বিনিয়োগের মধ্যদিয়ে। পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে তাদের জন্য সমসুযোগ ও সমঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তাদেরকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে। আর এই মানবসম্পদ গড়ার প্রক্রিয়াটি শুরু করতে হবে কন্যাশিশুর জন্মলগ্ন থেকেই। মনে রাখতে হবে আজকের শিশু কন্যা আগামী দিনের একজন মহিয়সী নারী।

নিউজটি শেয়ার করুনঃ