দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি “মধ্যবিত্তের নিরব কান্না”

চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধিঃ

দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি সাথে সাথে হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজরীয় দ্রব্যের। এ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষের জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত। বাজারে চাল, ডাল, তেল, নুন, পেঁয়াজ, শাকসবজি থেকে শুরু করে এমন কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নেই, যার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে না। এ
দ্রব্যমূল্যের সাথে মানুষের জীবনযাত্রার সম্পর্ক অতি নিবিড় ও বাস্তব।

একটি পরিবার ও একটি সমাজ কিভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবন চালাবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা ও দ্রব্যমূল্যের ওপর। পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় ও সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে তখন তাদের জীবন কাটে স্বস্তিতে।অন্য দিকে পণ্যের মূল্য যখন মানুষের আর্থিক সঙ্গতির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায় তখন তাদের জীবনে নেমে আসে হতাশা ও অশান্তি। বর্তমান সময়ে দেশে মধ্যবিত্ত মানুষই সবচেয়ে বেশি বিপদে আছেন। লজ্জায় তারা না পারছেন কাউকে বলতে, না পারছেন হাত পাততে। দৈনন্দিন জীবনে নেমে আসে অন্ধকার।

যার ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে চলছে নিরব কান্না। দেশে এমনিতে করোনা মহামারী ও বণ্যা পরিস্থিতির কারণে অভাব ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে আজকের জনজীবন দুঃখ ও হাহাকারে পূর্ণ। এরই মধ্যে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চেপে বসেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঘোটক। জীবনধারণের উপযোগী প্রতিটি জিনিসের অগ্নিমূল্য। চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, চিনি, লবণ, গম, আটা, রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি দ্রব্যের মূল্য আগের তুলনায় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ , গ্যাস, পানির দাম বৃদ্ধির প্রস্তব করা হয়েছে, ফলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ যা আয় করছে, তার পুরোটাই জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদির জন্য ব্যয় করার মতো অর্থ তাদের হাতে থাকছে না।

অথচ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে মানুষের ক্রয় ক্রমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়েছে মাথা পিছু আয়। কিন্ত বাস্তব চিত্র তার উল্টো। দেখা যায় শহরের প্রতিটি এলাকায় টিসিবি ন্যর্যমূল্যের গাড়ির পেছনে মানুষের দীর্ঘ লাইন, কিংবা তা ধরার জন্য প্রাণপণ দৌড় দেখে কে বলবে, এ দেশে মানুষের মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে? সম্প্রতি সরকার ঘোষণা করেছে দেশের বার্ষিক মাথাপিছু আয় এখন দুই হাজার ৫৯১ মার্কিন ডলার। এক মন্ত্রীতো বলেই দিলেন এদেশের মানুষ বেহেশতে আছেন। অথচ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে সারা দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ধকলেই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল মানুষের আয়ের আসল চিত্র।

যদি সত্যিই আয় বেড়ে থাকে তা হলে মানুষ কেন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপ নিতে পারছে না? নাকি নিমিষেই আয় কমে গিয়ে আমরা দরিদ্র হয়ে যাচ্ছি? সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, কোভিড-১৯-এর কারণে গত বছর থেকে এ পর্যন্ত বেকার হয়েছেন ২৬ লাখের বেশি মানুষ। কর্মজীবীদেরও আয় কমেছে উল্লেখযোগ্য পরিমান। এবং পাশাপাশি জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। কেননা, গড়পড়তা আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য একটি বাজার ব্যবস্থা যে কোনো দেশের সরকারের কাছে তার জনগণের প্রাণের দাবি।

দ্রব্যমূল্যের এ ঊর্ধ্বগতি থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকারি ও বেসরকারি অভিজ্ঞ মহলের সুদৃষ্টি অবশ্যই থাকা প্রয়োজন। অন্তত চারটি ডাল-ভাত খেয়ে বাঁচতে দিন নিম্ন আয়ের মানুষকে। বর্তমানে দেশে ব্যবসায়িরা জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির উৎসবে মেতে উঠেছে। ব্যবসায়ীদের এই লাগামহীন দামে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। দিনকে দিন বেড়েই চলেছে জীবন যাত্রার ব্যয়। সব কিছুর দাম বাড়লেও বাড়ছে না কেবল মানুষের আয়। এ অবস্থায় বিশেষ করে শহরের স্বল্প আয়ের মানুষের টিকে থাকা দায় হয়ে গেছে। ভালো নেই মধ্য আয়ের কর্মজীবী মানুষও। শুধু খাদ্যদ্রব্য নয়, জীবনযাপনে প্রয়োজনীয় সব কিছুর দামই হু হু করে বাড়ছে। এতে নাভিশ্বাস উঠেছে মধ্য আয়ের মানুষেরও।

মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করা ব্যক্তিরাও এখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বাসা ভাড়া, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ, অফিসে যাতায়াতসহ সংসারের যাবতীয় খরচের সাথে যোগ হয়েছে নিত্যপণ্যের লাগামহীন বাড়তি মূল্য। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানোর দুর্বিষহ সন্ধিক্ষণে উন্নয়ন আর জীবন বাঁচানোর অর্থনীতি, মাথাপিছু আয়ের সাথে সেবা ও নিত্যপণ্যের দামের ঘোড়দৌড় পরিলক্ষিত হয় টিসিবির ট্রাকের পেছনে মাস্ক মুখ লুকিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা চেহারাগুলোতে। মাস্কে মুখ ঢেকে মাথার পেছনে ৩০ থেকে হাজার টাকা আয় নিয়ে তারা সামনে দেখেন টিসিবির ট্রাক। বিগত কয়েক মাস ধরে চাল, ডাল, তেল, পানি থেকে পান-সুপারি পর্যন্ত বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দামের চঞ্চলতায় কাহিল মধ্যে আয়ের মানুষগুলো।

যদিও মাথার পেছনের আয়ের গড়ের অঙ্কে তারা ‘সামর্থ্যবান’। আয়ের অঙ্কটা মাথার পেছনে বলে তারা তা চোখে দেখেন না, মাথার সামনে থাকলে দেখতেন-আসলে বিষয়টি এমন নয়। দেখা যায় সংসার নামের বোঝা যার কাঁধে সে শত কষ্টেও কাবু হয় না। কথায় আছে, পুরুষ মানুষ খুবই শক্ত মনের অধিকারী, সহজে কাঁদে না। যদি কাঁদে, তবে সেই কান্নার কারণটা হয় খুবই বেদনাদায়ক। সে দিন দেখলাম এলাকায় টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে এসে অঝরে কাঁদলেন এক বাবা। জানালেন তার কষ্টের কথা। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কান্নার সুরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নাগালের মধ্যে আনার আকুতিও জানান তিনি। বললেন, যদি তা না হয়, না খেয়েই জীবন কাটাতে হবে সন্তানসহ তাদের।

নিউজটি শেয়ার করুনঃ