দুদকের অভিযুক্তরাই পুরস্কৃত চট্টগ্রাম’র বিআরটিএতে

বিশেষ প্রতিনিধিঃ

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) চট্টগ্রাম’র অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কয়েকজনের বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থরা দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকে অভিযোগ করলেও দুদকের অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তির পরিবর্তে কর্তৃপক্ষ পদুন্নোতি দিয়ে পুরস্কৃত করেছে বলেও খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া বিআরটিএ অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একই অফিসে দীর্ঘদিন ধরে চাকরী করার কারণে সরকারি বিধি মোতাবেক বদলী না হওয়ার করাণে অনিয়ম দুর্নীতিতে বেপরোয়া হয়ে পড়ছে। কেউ কেউ একই অফিসে ৫/৭ বছর ধরে চাকুরী করে আসছে। তাদের দুর্নীতি-যেন অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। বিআরটিএ’র চেয়ার-টেবিলও দুর্নীতির ভাগিদার! সংস্থাটির বিভিন্ন কর্মকর্তা দুর্নীতির মাধ্যমে কেবল অর্থ লুটপাট করেছেন।প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী থেকে শুরু করে বড় কর্মকর্তারাও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে দুর্নীতির আঁখড়া বানিয়েছেন বিআরটিএকে। সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করে নিজেদের পকেট ভারি করেছেন বিআরটিএ’র সংঘবদ্ধ চক্র।

সৃত্রে জানায়, যানবাহন রেজিস্ট্রেশন, নবায়ন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ফিটনেস, রুট পারমিটসহ নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতির কারণে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আত্মসাৎকৃত অর্থ চলে গেছে বিআরটিএ সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তাদের পকেটে। অনেকের বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতি করে কয়েক শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার তথ্য রয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকায় এবং রাজধানী ও তাদের গ্রামের বাড়িতে একাধিক বাড়ি গাড়ি জমি জমাসহ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য অসুন্ধানে বেরিয়ে আসছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে রুট পারমিট, ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন, ডিজিটাল নম্বরপ্লেট, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ কোনো কাজই হয় না ঘুষ ছাড়া। আর এই ঘুষ লেনদেনের মূল মাধ্যম তাদের নিজস্ব দালাল সিন্ডিকেট। দালাল আর ঘুষ নিয়ে দুদকসহ বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষতিগ্রস্থরা বিভিন্ন সময় অভিযোগ জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা। তবে বিআরটিএ অফিসের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলে তাকে হত্যার হুমকি মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো এমনকি সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছে।শ্রমিক নেতা নজরুল ইসলাম খোকন নামের একজন বিআরটিএ অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার কারণে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছিল।

তথ্যমতে চট্টগ্রাম’র মহানগর ও জেলায় ছোট বড় প্রায় দুই লাখ গাড়ি চলাচল করে। এর মধ্যে প্রায় ১ লাখের বেশী গাড়ির ফিটনেস নেই। নেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও। অথচ বছরের পর বছর রাস্তায় চলছে এসব গাড়ি। এতে নিত্য দুর্ঘটনা ঘটছে প্রাণহানিও। পরিবহন সংগঠনের নেতারা বলছেন, ফিটনেস না থাকলে ডিজিটাল নম্বরপ্লেট না দেওয়ার কথা। কিন্তু নির্ধারিত ফির সঙ্গে ঘুষ দিলেই মিলছে ডিজিটাল নম্বরপ্লেট। নতুন গাড়ি রেজিস্ট্রেশনে নম্বরপ্লেটের জন্য আদায় করা হচ্ছে ৪ হাজার ৬২৮ টাকা। আগে রেজিস্ট্রেশন হয়েছে এমন গাড়ির নম্বরপ্লেটের জন্য আদায় করা হচ্ছে ৩ হাজার ৬৫২ টাকা। একইভাবে প্রতিটি বাসের রুট পারমিট ও ফিটনেসের জন্য ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার, হিউম্যান হলার ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার, ট্রাক ২ হাজার থেকে ৩ হাজার, ড্রাম ট্রাক ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার, মিনিট্রাক ২ হাজার থেকে ৩ হাজার, টেম্পু ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার, অটোরিকশা ৪ হাজার ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য অতিরিক্ত ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা বাড়তি দিতে হয়। ফলে ফিটনেসবিহীন গাড়ির চালকরাও পাচ্ছে লাইসেন্স।

এছাড়াও চট্টগ্রাম মহানগরীতে অটোরিক্সার আদলে ম্যাক্সিমা, এইচ পাওয়ার, মাহিন্দ্রা, টমটমসহ ৪ সিটের প্রায় ৩ হাজার থ্রি হুইলার নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। এগুলো দুবছর ধরে চলাচল করছে নগরীতে। এছাড়া ১০ সিটের অটোটেম্পুুও নিবন্ধন দেওয়া হয়। টাকার বিনিময়ে সরকার যেসব গাড়িতে নাম্বার না দেয়ার জন্য নিষেধ করেছে সেগুলোতেও নাম্বার দিচ্ছে বিআরটিএ। চট্টগ্রাম মেট্রো ও জেলা অফিস মিলে ৪ হাজার ১৫৩টি গাড়ির রেজিস্ট্রেশনে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেট্রো-১ সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) তৌহিদুল ইসলাম বর্তমান পদোন্নতি পেয়ে উপ পরিচালক, পরিদর্শক মোহাম্মদ জামাল, অফিস পিয়ন মোহাম্মদ ইসলামসহ ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার দায়িত্ব থাকলেও পুরো বিআরটিএ যত অনিয়ম দুর্নীতি সিন্ডিকেট করে নিয়ন্ত্রন করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিআরটিএ চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক হিসেবে শফিকুজ্জামান ভুইয়া কাগজে কলমে দায়িত্বে থাকলেও পুরো নিয়ন্ত্রন করে এ তিনজন। এ তিন জনের হাতে জিম্মি পুরো বিআরটিএ। এ তিন জনের বিরুদ্ধে ২০০২ সালে এবং ২০০৫ সালের আমদানিকৃত পুরানো চট্টমেট্টো থ-১২ সিরিয়ালের সিএনজি টেক্সী ভেঙ্গে নতুন নাম্বার প্লেট দেয়ার সরকারের নির্দেশ দিলেও তাদের চাহিদা মত গাড়ি প্রতি এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দাবি করে। ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর তথ্য মতে প্রায় দুই হাজার গাড়ি। তৎকালিন সময়ে প্রায় দেড় হাজার গাড়ি দেড় দুই লাখ টাকা দিয়ে পুরাতন গাড়ি ভেঙ্গে নতুন নাম্বার প্লেট নিয়েছে। নতুন নাম্বার প্লেট দেয়ার কথা বলে তারা কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি করেছে। তাদের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগও রয়েছে। যারা টাকা এখনো তাদের দাবিকৃত ঘুষ দিতে পারেনি তারা এখনো নতুন নাম্বার প্লেটের জন্য আবেদন করলে গাড়ি এ সমস্যা ঐ সমস্যা বলে নতুন নাম্বার দিচ্ছে না। বর্তমান সময়ে তৌহিদ সিন্ডিকেটের অবহেলার কারণে ৫ শতাধিক পুরানো সিএনজিকে নতুন নাম্বার প্লেট না দিয়ে হয়রানি করে আসছে।

বায়েজিদ এলাকার নাজিম উদ্দীন নামের এক সিএনজির মালিক জানান, পুরানো আমালের সিএনজিগুলো ভেঙ্গে নতুন নাম্বার প্লেট দেয়ার কথা বলে বিভিন্ন সময় খবর পাঠানো এবং বিজ্ঞপ্তি দিলেও তারা টাকা ছাড়া গাড়িগুলো ভাঙ্গে না। তারা মোটা অংকের টাকা দাবি করেন। টাকা দিলে সাথে সাথে ভেঙ্গে নতুন নাম্বার প্লেট করে দিবে। তৌহিদুল ইসলামের সাথে কথা বলতে চাইলে পিয়নের সাথে কথা বলে দর দাম নির্ধারণ করতে বলেন। তিনি আরও জানান, যদি তাদের কথায় রাজি না হইলে বছরের পর বছর ঘুরলেও নতুন নাম্বার প্লেট পাওয়া যাবে না।

অভিযোগের বিষয়ে বিআরটিএ চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপ পরিচালক, অভিযুক্ত তৌহিদুল ইসলামের সাথে বিভিন্নভাবে বক্তব্য নেয়ার জন্য যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন মানুষদেরকে দিয়ে পত্রিকায় যাতে তার বিরুদ্ধে নিউজ প্রকাশিত না হয় সেটা নিয়ে কয়েকদিন ধরে লবিং চালিয়েছে। বিআরটিএ বিভাগীয় পরিচালক শফিকুজ্জামান ভুইয়া জানান, অফিসের কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। অফিসের বাইরে কোন দালালের হাতে কেউ যদি হয়রানির শিকার হয় তার দায় ভার আমরা নিব না। ক্ষতিগ্রস্থরা সরাসরি আমার অফিসে আসলে আমি সহযোগিতা করব।

নিউজটি শেয়ার করুনঃ