“৬২ বছরের ইতিহাসে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে তালা” চট্টগ্রাম’র প্রেসক্লাব অচল ক্লাবের সদস্য হতে সংবাদকর্মীর বাধা কেন

হোসেন মিন্টুঃ

৫ ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগের পর প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে তালা দিয়েছেন বৈষম্য বিরোধী গণমাধ্যমকর্মীরা, এ যেন এক নতুন ইতিহাস।

চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব গঠিত হয় ১৯৬২ সালে। পরবর্তী ১৯৬৪ সালের ২৯ আগস্ট পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খান চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের উদ্বোধন করেন। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের ৬২ বছরে অনেক হামলা মামলা হলেও প্রথমবারের মতো তালা ঝুলছে ২০২৪ সালের ৫ ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগের পর।বাংলাদেশের প্রতিটি প্রেসক্লাব গুলোতে এভাবেই রুখে দাঁড়ান বৈষম্য বিরোধী গণমাধ্যমকর্মীরা। এতে বাদ পড়েনি চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব।

৫ ই আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগের পর বৈষম্য শিকার সাংবাদিকরা একে একে জড়ো হয়ে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে তালা ঝুলিয়ে দেন এবং প্রেসক্লাবের কমিটিকে অবৈধ বলে ঘোষণা দেন। সেই সাথে স্লোগান দেন বৈষম্য শিকার গণমাধ্যম কর্মীরা ফ্যাসিবাদ মুক্ত প্রেসক্লাব চাই, ফ্যাসিবাদের দোসরেরা হুশিয়ার সাবধান,

৬ আগস্ট চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব প্রাঙ্গনে সকলে একত্রিত হয়ে বৈষম্য বিরোধী সাংবাদিক ঐক্য নামে একটি সংগঠন তৈরি করে। বৈষম্য শিকার সকল সাংবাদিকরা একত্রিত হয়ে এক এক করে সকলের দাবি জানান এবং মানববন্ধন করেন প্রেসক্লাব প্রাঙ্গনে।

এ সময় একজন বৈষম্য শিকার গণমাধ্যম কর্মী বলেন আমরা কখনো চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে স্বাধীনভাবে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারিনি, আমরা চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সদস্য না বলে প্রেসক্লাবে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারবোনা, আমাদের অনলাইন চ্যানেল, দৈনিক পত্রিকা, আমাদের পত্রিকা গুলো স্বনামধন্য এক থেকে দশটি পত্রিকার মধ্যে নয়। আমাদের পত্রিকাগুলো তো সরকার অনুমোদিত, অবৈধ নয়। আমাদের পত্রিকা গুলোকে আন্ডারগ্রাউন পত্রিকা বলা হয়। আরো নানান ভাবে আমাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হয়। সংবাদ সংগ্রহের সময় আমাদের  মাইক্রোফোন সরিয়ে দেওয়া হয়, কখনো আবার ক্যামেরা ফেলে দেওয়া হয়।

এ সময় আরেকজন গণমাধ্যম কর্মী বলেন ৩০ বছর সাংবাদিকতা করছি এখনো চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্য হতে পারিনি। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্য হতে হলে প্রথমে সাংবাদিক ইউনিয়ন অথবা চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য হতে হবে। এখানেই শেষ নয় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্য ফরম নিয়ে সেই প্রেসক্লাবের ১৫ জনের ভোট লাগবে। সাথে রাজনৈতিক সুপারিশ লাগবে। তার আগে আপনাকে কাজ করতে হবে বাংলাদেশের স্বনামধন্য পত্রিকা গুলোতে, অথবা টিভি চ্যানেল গুলোতে, তৃণমূলের সকল সংবাদ কি স্বনামধন্য পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেল গুলোকে সংগ্রহ করে? তৃণমূলের সকল সংবাদ সংগ্রহ করি আমরাই বৈষম্যের শিকার গণমাধ্যম কর্মীরা। এবার আপনারাই বলুন এত কিছু করে কি প্রেসক্লাবের সদস্য হওয়া সম্ভব?

অন্য এক গণমাধ্যম কর্মী বলেন আমরা চট্টগ্রামের কোথাও নিউজ করতে গেলে আমাদের জিজ্ঞাসা করা হয় আমরা কি প্রেসক্লাবের সদস্য নাকি? প্রেসক্লাবের সভাপতিকে চিনেন সাধারণ সম্পাদক কে চিনেন? আবার ওখান থেকে ফোন দেওয়া হয় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সেক্রেটারি অথবা সভাপতির কাছে, ওনারা আমাদের চেনে না বলে বেঁধে রাখুন হলুদ সাংবাদিক ভুয়া সাংবাদিক।
একজন সংবাদকর্মী অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের একটি অভিযানে নিউজ করতে গেলে সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট প্রশ্ন করেন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতির নাম কি? সেক্রেটারির নাম কি? তখন আমরা উত্তর দিতে পারি না। আমি গণমাধ্যম কর্মী সাংবাদিকতা করতে এসেছি আমি কেন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি সেক্রেটারির নাম মুখস্ত করব এজন্য আমাকে নানারকম হয়রানি শিকার হতে হয়।

আরেকজন গণমাধ্যম কর্মী জানান, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের ভিন্ন এক রূপ যদিও চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব একটি সাংবাদিকদের পেশাজীবি সংগঠন এবং মিলনসভা। কিন্তু এই প্রেসক্লাব পরিচালনা করে আসছে অন্য ভাবে। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের ভিতরে রয়েছে হাউজি ঘর যেখানে প্রতিনিয়তই চলে জুয়া  এবং মদের সাম্রাজ্য। এমন আরো হাজারো অভিযোগ রয়েছে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব এবং প্রেসক্লাবের কমিটির বিরুদ্ধে।

এভাবেই শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধন ও কর্মসূচি পালন করে আসছে বৈষম্য বিরোধী সাংবাদিক ঐক্য সংগঠনটি। এদিকে অবৈধ বলে ঘোষণা দেওয়া চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাবেক কমিটি কৌশল অবলম্বন করে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের দ্বারস্থ হয়ে চট্টগ্রামের সাবেক কমিটির তিন জনের একটি টিম রাতের আঁধারে জেলা প্রশাসকের সাথে গোপন বৈঠক করেন। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক শেখ হাসিনা সরকারের রেখে যাওয়া এক প্রেতআত্মা, যার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক অনিয়ম ও দুর্নীতির  অভিযোগ।

২০ আগস্ট চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবীতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচী পালন করেন বৈষম্য বিরোধী সাংবাদিক ঐক্য। এক পর্যায়ে কুখ্যাত জেলা প্রশাসককে চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় বৈষম্য বিরোধী সাংবাদিক ঐক্যের নেতৃবৃন্দ।

এক পর্যায়ে আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ঢাকা থেকে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা বৈষম্য বিরোধী সাংবাদিক ঐক্যের নেতাদের আশ্বস্ত করে জানান, আজই চট্টগ্রামের ডিসিকে প্রত্যাহার করা হচ্ছে৷ ডিসি আবুল বাশারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেয়ার এরপরই আন্দোলনকারীরা অবস্থান কর্মসূচী সমাপ্তের ঘোষনা দেন।

পার্ট (২) চট্টগ্রাম’র প্রেসক্লাব অচল “ক্লাবের সদস্য হতে সংবাদকর্মীর বাধা কেন” চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব বৈষম্য বিরোধী সাংবাদিকদের দাবির কারণে তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। এই সংকট সমাধানের জন্য অনেকে চেষ্টা করেছেন, তবে এখনো সন্তোষজনক সমাধান হয়নি। বর্তমানে আমাদের নবনিযুক্ত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা, ফারুকে আজম, বীর প্রতীক, এই সংকট সমাধানের জন্য একটি উদ্যোগ নিয়েছেন।একজন সাংবাদিক বা সংবাদকর্মী হিসেবে প্রেসক্লাবে সদস্য হওয়া তাদের অধিকার। যেহেতু ক্লাবটি সংবাদকর্মীদের বিনোদনের স্থান, এই ক্লাব কিন্তু সাংবাদিক বানানোর কোনো কারখানা নয়। সাংবাদিকরাই ক্লাব বানাতে পারেন, কিন্তু ক্লাবে সাংবাদিক তৈরি করা যায় না। সেই কথাটি সবাই জানার এবং বোঝার পরেও কেন যেন না বোঝার ভান করে অহেতুক ঝামেলা সৃষ্টি করে। সবাই জানেন, একজন খেলোয়াড় তার খেলার ক্লাবে সদস্য হবেন, একজন শিল্পী তার নির্দিষ্ট ক্লাবে সদস্য হবেন, একজন আইনজীবী এবং শিক্ষক যদি তাদের পেশাগতভাবে সংশ্লিষ্ট ক্লাবে সদস্য হতে পারেন, তাহলে প্রেসক্লাবে সংবাদকর্মী সদস্য হতে বাধা সৃষ্টি হবে কেন? হ্যাঁ, প্রেসক্লাবেও সদস্য হচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও হবেন। তবে সমস্যাটা হলো এক শ্রেণীর দালাল এবং আত্মঅহংকারী সাংবাদিকদের নিয়ে। তারা কোনো না কোনোভাবে ক্লাবের সদস্য হয়ে সরকারের দালালি ও চামচামি করে ক্লাবকে তাদের পৈতৃক জমিদারি এস্টেট বানিয়ে বাবুগিরি করছেন। তারা এই ক্লাবের পদ-পদবি ব্যবহার করে বিভিন্ন অবৈধ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন, যা অপ্রিয় হলেও সত্য। এক কথায়, ক্লাব তাদের হাতে জিম্মি। আজ বৈষম্যের শিকার সংবাদ কর্মীদের প্রশ্ন হল, আমরা যারা সংবাদপত্রের সাথে জড়িত, কেন আমরা সদস্য হতে পারব না? এই ‘কেন’ শব্দের উত্তর খুঁজতে গিয়ে হাজারো প্রশ্ন চলে আসে। আমরা জানি, কিছু কিছু ক্লাব রয়েছে যা এখনো শোষকদের প্রতিনিধি হয়ে আছে, যেমন চিটাগং ক্লাব। এই ক্লাবটি ইংরেজদের হাতে প্রতিষ্ঠিত; যে ইংরেজ এই ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি ছিলেন ১৮৭৮ সালে এই দেশে প্রথম চা বাগানের মালিক তিনি হলেন “ডব্লিউ ক্যাম্পারেল” তিনিই এই চিটাগং ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই চা বাগানের নাম ছিল গুন্ডু চা বাগান, যার অবস্থান ছিল বর্তমান চিটাগং ক্লাবের স্থানে। সেই স্থান থেকে পুরো দামপাড়ার দিকে বিস্তৃত ছিল এটি। আজ সেই ইংরেজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত চিটাগং ক্লাব এখনো ইংরেজদের কবল থেকে মুক্ত হতে পারেনি, এখনো ইংরেজদের বৈষম্য নীতিতে ক্লাব পরিচালিত হয়। ঠিক তেমনি, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ১৯৬২ সালে পাকিস্তান আমলে জাতিগত বৈষম্যের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখনকার বৈষম্যতা এখনো ক্লাব কর্তৃপক্ষ ধারাবাহিকভাবে বজায় রেখে চলেছে। একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন সাংবাদিক তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে কেন? ক্লাবের সদস্যরা নিজেদের পরিচয় দেন, তারা নাকি মূলধারার সাংবাদিক, আর যারা ক্লাবের সদস্য নন, তারা কোনো সাংবাদিকই নন; তারা স্বৈরাচার সাংবাদিকদের ভাষায় ভুয়া সাংবাদিক। কোন বইতে ‘মূলধারার সাংবাদিক’ লেখা নেই। শুধু মাত্র অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্রী এই ‘মূলধারার সাংবাদিক’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, যা কিন্তু সংবাদপত্রের বিধিবিধানে উল্লেখ নেই। তাই আমি বলি, মূলধারার বিপরীত শব্দ হলে গুণধারা, যারা ক্লাব সদস্য হয়ে মূলধারা বলেন, যারা সদস্য নন, তারা হলো গুণধারা সাংবাদিক কারণ তাদের মধ্যে অনেক গুণাগুণ রয়েছে। শিক্ষার সনদের কথা বলা হয়, সাংবাদিকতায় কোনো পাঠ্য শিক্ষার মাপকাঠি নেই। সাংবাদিকতা নির্ভর করে মেধা এবং অভিজ্ঞতার উপর। যার যত মেধা বেশি, তিনি একজন মেধাবী সাংবাদিক; যার যত অভিজ্ঞতা বেশি, তিনি একজন বিজ্ঞ সিনিয়র সাংবাদিক। অনেকেই বলেন, সাংবাদিকতা করতে হলে উচ্চ শিক্ষিত হতে হবে, তা সঠিক নয়। একজন উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি কয়টা পাঠ্যবই পড়েছেন? প্রাইমারি থেকে উচ্চতর ডিগ্রি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে হলে বেশি হলে ৫০০টি পাঠ্যবই পড়েছেন। কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক সাংবাদিক আছেন যারা কোনোদিন স্কুলের বারান্দায়ও যাননি, অথচ লক্ষ লক্ষ বই পড়েছেন। তাহলে কে বেশি পড়াশোনা করেছেন নির্দিষ্ট পাঠ্য শিক্ষায় শিক্ষিত নাকি যারা অঢেল বই পড়েছেন? এখন আরো একটি শব্দ সংযুক্ত করা হয়েছে, অনলাইন সাংবাদিক। অনলাইন সাংবাদিকতা যারা করেন, তারা নাকি কোনো সাংবাদিকই নন! বুঝি না, এই আধুনিক এবং মুক্ত সাংবাদিকতার যুগে তারা কী বলে? এখন সংবাদপত্র একমাত্র নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ডিজিটাল তথ্য বিনিময়ের উপর। সেইখানে অনলাইন সাংবাদিকতাকে কীভাবে অস্বীকার করা যায়?

নিউজটি শেয়ার করুনঃ