”২৩শে মার্চ সোয়াত জাহাজ ঘেরাও দিবস” হালিশহর এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করছি
হোসেন বাবলা,চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধিঃ
১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বেলা ২টার দিকে বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে পাকিস্তানের এমভি সোয়াত নামে একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের ৭নং জেটিতে নোঙর করে। সেই সোয়াত জাহাজে অস্ত্র আসার খবর মূহুর্তে ছড়িয়ে পড়লে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের শ্রমিক-ছাত্র জনতা প্রথমে জেটি এলাকায় পরে সেই সংবাদ আরো স্বক্রিয় ভাবে একজন শ্রমিক অত্যন্ত গোপনে সিবিএ‘র নেতা আবুল বাশার কে জানালে, শ্রমিক নেতা বাশার তৎকালীন পতেঙ্গা- হালিশহর শিল্পাঞ্চলের (স্টীল মিল)’র প্রায় ৬-৭হাজার শ্রমিক, স্থানীয় জনতা নিয়ে তীব্র আন্দোলনে দাবানলের মতো জ্বলে উঠে মুক্তিকামী বাঙালি। সেই আন্দোলন থেকে অস্ত্র খালাস প্রতিরোধের ডাক আসে ২৩শে মার্চ দুপুরে। প্রতিরোধ করতে গিয়ে আবারও পাক সেনাদের গুলির মুখে পড়েন প্রতিবাদী স্থানীয় শ্রমিক ছাত্র- জনতা। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরুর আগেই ২৩শে মার্চ সোয়াত জাহাজের অস্ত্র খালাস প্রতিরোধের সেই দিনটি আসলে ৯মাস ব্যাপী বাঙালির জনযুদ্ধ-র শুরু। ২৩ মার্চ সোয়াত জাহাজ প্রতিরোধের জন্য যে রক্তস্নাত আন্দোলন হয়ে ছিল সেটা জনযুদ্ধে আরো ব্যাপকতা দেয়। ২৪শে মার্চ সেই আন্দোলনে শ্রমিক, ছাত্র, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সাধারণ জনতা সবাই ছিলেন। আর চট্টগ্রামে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ রাতে। যাকে ইতিহাসে কাল রাত্রি হিসেবে উল্লেখ করেন।

সেদিন ক্যাপ্টেন রফিক হালিশহরে ইপিআরের ক্যাম্প দখল করে প্রায় ১৫০জন অবাঙালি সৈন্য হত্যা করেন। সোয়াত জাহাজে অস্ত্র খালাসে অস্বীকৃতি জানালে চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিকদের উপর চড়াও হয় পাকিস্তানি সেনারা। বিভিন্ন ভাবে চাপ দিয়ে ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে প্রায় ১৫০ শ্রমিককে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে খুন করা হয়। এই ঘটনার পর শ্রমিকরাও সেই সময় চলা উত্তাল অসহযোগ আন্দোলনে পূর্নমাত্রায় যোগ দেয়। যে কোন জনযুদ্ধের জন্য এই ধরনের ঘটনা নিঃসন্দেহে একটা বড় ঘটনা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যে সত্যিকারের জনযুদ্ধ ছিল এটাই তার অন্যতম বড় প্রমাণ।বন্দরের এক ক্ষুব্ধ ডক শ্রমিক সোয়াত জাহাজ থেকে ২৪শে মার্চ অস্ত্র খালাস হবে বলে এমন তথ্য পৌঁছে দেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানের কাছে। তিনি বিষয়টি ঢাকায় আওয়ামী লীগের নেতাদের জানালে, কেন্দ্রীয় নির্দেশনা আসে, কোনভাবেই সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে দেয়া যাবে না এবং জাহাজের পাকিস্তানী সৈন্যদেরও নামতে দেয়া যাবে না। চট্টগ্রামের তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে জহুর আহমদ চৌধুরী, মজিদ মিয়া, ইসহাক মিয়া, আতাউর রহমান খান কায়সার, আবদুল্লাহ আল হারুন, আবু সালেহ, এস এম জামালউদ্দিন, মোহাম্মদ হারিছ মিয়া সভা-সমাবেশে সোয়াত জাহাজে করে অস্ত্র আনার বিষয়টি তুলে ধরে জনতাকে প্রতিরোধের আহ্বান জানান। ২৪শে মার্চ ১৯৭১ বিকেল ৪টায় সোয়াত জাহাজ অবরোধের ডাক দিয়ে বন্দরের নিউমুরিং কলোনির মাঠে(চাঁন খালীর মাঠ) সমাবেশ ডাকাহয়।সেদিন সোয়াত জাহাজ প্রতিরোধের সমাবেশ আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা শামসুদ্দিন, তরুণ ছাত্র আব্দুস সাত্তার ও তারেক, শ্রমিক নেতা এম.এ তাহের। সেই সমাবেশে শুধু ছাত্র-তরুণই নয়, বন্দরের শ্রমিক এবং নিউমুরিং কলোনি সহ আশপাশের এলাকার সাধারণ বাসিন্দারাও যোগ দেন। সন্ধ্যার দিকে সমাবেশস্থলে খবর আসে অস্ত্র খালাসের জন্য সোয়াত জাহাজ জেটিতে ভিড়েছে। সমাবেশ থেকে ৪-৫ হাজার মানুষ স্টিলের রড নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের তিন নম্বর জেটি অভিমুখে মিছিল শুরু করে। চকবাজারের প্যারেড গ্রাউন্ডে সেদিন মঞ্চস্থ হচ্ছিল নাটক ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তাদের কাছে খবর পৌঁছার পর জনতা নাটক দেখা বন্ধ করে বন্দরের দিকে রওনা দেয়। বন্দর থেকে ডক শ্রমিকরাও বেরিয়ে আসে। আর সেই সময়ে বন্দর হালিশহর-পতেঙ্গা শিল্পা অঞ্চলের হাজার হাজার জনতার মধ্যে স্মরণ করার মতো পাওয়াই তারা হলেন ইসহাক মিয়া, মজিদ মিয়া, শফিউল আলম (আঃলীগ সেক্রেটারী), মোজাহের (কালামিয়া), সাবেক কমিশনার জানে আলম বাহার, এম. এ তাহের(শ্রমিক নেতা), কামাল কমিশনার, আঃ মুমিন, মোঃ আলী, ডাঃ মাহাবুবর রহমান শরীফ, এডঃ জানে আলম, মোঃ ফছিউল আলম, মোঃ ইলিয়াছ, প্রয়াত সিরাজুল আমিন, আব্দুস সোবহান, আঃ মোতালেব, আব্দুল হাই, আবুল হাশেম (আটিস্ট), পরিক্ষিত দাশ, হারুণ অর রশিদ, কাশিম মাস্টার, তোতা ও বতামিয়া, প্রয়াত কামাল আহম্মদ (সাইলো), কামাল উদ্দিন (জি.এম), এড: শামসুল আলম, আবুল কালাম, জালাল আহম্মদ, এম.এ কাশেম, আবু জাফর, জাফর আহম্মদ, ডাঃ আইয়ূব আলী, ফিরোজ আহম্মদ, কামাল উদ্দিন, জামাল উদ্দিন, ছাবের আহম্মদ, মিনহাজ, জাকারিয়া, জালাল আহম্মদ, প্রয়াত মোঃ ইদ্রিস সওঃ (ওয়াটার সেকশন), আমেরিকা প্রবাসী মোঃ আলী, জাফর আহম্মদ জাপরী, মোঃ ইউসুপ(সোনামিয়া), মোঃ নাছির উদ্দিন, ফজলুল কাদের সহ অসংখ্য শ্রমিক নেতৃবৃন্দ। সোয়াদ জাহাজ ঘেরাও এর অনেকই আজো বলছেন সেই দিনের মরাস্ত্র প্রতিরোধ না হলে হয়তো আজকের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বাধীন রাষ্ট্র হতো কিনা সন্দেহ ছিল। সেই আন্দোলনটি প্রকৃত ঘঠে ছিল বর্তমানের রুবি সিমেন্ট ফ্যাক্টুরীর সংলগ্ন (সালাউদ্দিন) গেইট নামক স্থানে। সেই দিন দুপুরেই শ্রমিকরা ইটের কংকর, মরিচের ঘুড়া আর বাশেঁর লাটি ও রড দিয়ে প্রথমে প্রতিরোধ শুরু করে। পরে অবশ্যই শ্রমিক জনতা ইপিআর বাহিনীর মাধ্যমে তাদের ফেরত যেতে বাধ্য করেন। আর সেই জাহাজের ক্যাপটেন ছিলেন মেজর জিয়া। তিনি পরে আবারো অস্ত্র খালাসের চেষ্টা করলে তীব্র আন্দোলন আর প্রতিরোধের মুখে মেজর জিয়াও জাহাজ রেখে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে চলে যান। এই অপারেশনে জিয়া কে পরে দায়িত্বে দেন, এর আগে পাকিস্তানের অন্য একজন কর্মকর্তা ছিলেন। তবে যাই ঘটুক দেশে সেই দিন এই শ্রমিক জনতাই বীরের বেশে পাকিস্তান সৈন্যদের প্রথম প্রতিরোধর ডাক দেন। তাই মহান এই দিবসে তাদের শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি। সেই দিন টি ছিল ২৩শে মার্চ দুপুর আনুমনিক সময় ২ঃ৩৫ মিনিট।

নিউজটি শেয়ার করুনঃ